ছেলেটি কারাগারে, মেয়েটি সেফ হোমে

ভালো লাগা থেকেই একে অপরের প্রেমে পড়েছিল এক কলেজ পড়ুয়া ছাত্র ও এক কিশোরী স্কুল ছাত্রী। কিন্তু ‘উচ্চবিত্ত অভিজাত’ বলে পরিচয়দানকারী মেয়ের পরিবার এ অসম প্রেম মেনে নিতে পারেনি। ‘অপ্রাপ্তবয়স্কা মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে’ বলে - বাবার ঠুকে দেয়া মামলায় ছেলেটিকে ১৪ বছরের জেলের সাজা দিয়েছেন বিচারক। এদিকে কিশোরী প্রেমিকাও অভিমানে ফিরে যায়নি তার বাবা মা’র কাছে। আশ্রয় নিয়েছে সরকারী সেইফ হোমে। এভাবেই করুণ পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে দুটি তরুণ প্রাণকে। 
গত ২৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার শেরপুরের শিশু আদালতের বিচারক অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ মোছলেহ উদ্দিনের দেয়া রায় মাথায় নিয়ে প্রেমিক যুগল চলে গেছে কারাগারে আর সেইফ হোমে। প্রেমের বাঁধনকে তারা অটুট রেখেছে। কিশোরী প্রেমিকাকে বাবা মা ও অন্য অভিভাবকদের রক্তচক্ষু, শত অত্যাচার, নানা প্রলোভন একটুও টলাতে পারেনি। চিড় ধরাতে পারেনি তাদের ভালোবাসায়। তাদের কাহিনী যেন হার মানায় যেকোন সিনেমার চরিত্রকে।
ঘটনাটি জানতে হলে ফিরে যেতে হবে কয়েক বছর পেছনে। ছেলে ও মেয়ে দুজনেই শহরের একই স্কুলে পড়াশুনা করত। ছেলেটির নাম সোবাহান উদ্দিন জিহান। সে শহরের নবীনগর মহল্লার বাসিন্দা। প্রগতিশীল সংস্কৃতিমনা ও সমাজসেবী নামে এলকায় যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে। অপরদিকে মেয়েটি মেধাবী বিতার্কিক বলে খ্যাতি রয়েছে। বাবা হার্টের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আর মা অধ্যাপিকা। কিন্তু মেয়েটি জন্মের ১৭ দিন পর থেকেই তার ফুপু ফুপার কাছে লালিত পালিত হয়েছে। তাদেরকেই ছোটবেলায় মা বাবা হিসেবে জানতো। সাত আট বছর বয়স হলে সে জানতে পারে তার বাবা একজন ডাক্তার এবং মা অধ্যাপিকা। তার আরো দু’টো বোন রয়েছে। তারা বাবা মা’র স্নেহে পালিত হচ্ছে। অনেকের ধারনা ছেলেবেলায় জন্মদাত্রী মা বাবার স্নেহ মমতা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় পুঞ্জিভূত অভিমান তাদের প্রতি মেয়েটিকে দ্রোহী করে তোলে।
মোবাইল ফোনে রং নাম্বারের সূত্র ধরে ছেলেমেয়েটির আলাপ। সে আলাপ থেকেই পরবর্তীতে ‘টিনএজার’ দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে গভীর প্রেমের সম্পর্ক। কিন্তু দু’বছর ধরে চলা এ ঘটনা চাপা থাকেনি। মেয়েটির বাবা মা ফুপা ফুপু বা পরিবারের লোকজনও এতদিনে জেনে যায় এই সম্পর্কের কথা। ফলে বাঁধা আসে তথাগত অভিজাত উচ্চবিত্ত গর্বিত পরিবারের পক্ষ থেকে। তীক্ষ্ণ নজর রাখে তারা। কিন্তু তাদেরর রক্তচক্ষু, অত্যাচার আর শাসনের লৌহকঠিন শেকলের বন্ধন মেয়েটিকে তার ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছাকে উসকে দেয়।

অভিভাবকদের কড়া নজরদারীকে ফাঁকি দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা চলাকালে ২০১৫ সালের ১৪ মার্চ সরকারী ভিক্টোরিয়া একাডেমি কেন্দ্র থেকে প্রেমিককে সঙ্গে নিয়ে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি জমায়। শিক্ষিত অর্থবিত্তশালী অভিজাত ও প্রভাবশালী পরিবার এ ঘটনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যে কোনো মূল্যেই তারা কিশোরী মেয়েকে অসম প্রেমের কবল থেকে উদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে অপরহরনের অভিযোগে প্রেমিক ছেলে, ছেলের মা বাবা সহ ৫ জনের বিরূদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। পুলিশ ছেলের মা বাবা সহ অন্যান্যদের গ্রেফতার করে হাজতে ঢোকায়। কিন্তু টিনএজার প্রেমিক প্রেমিকার বেশী দিন পালিয়ে থাকা হলো না। ২১ এপ্রিল ২০১৫ তারা শেরপুর সদর থানায় আত্মসমর্পন করে। মামলা আদালতে গড়াল। মেয়ের বাবা মা, তাদের উকিল কিশোরী মেয়েকে দিয়ে ‘জোড় পূর্বক তাকে অপহরণ করা হয়েছে’ এ সাক্ষ্য দিতে বলা হলো। কিন্তু কিশোর প্রেমে দায়বদ্ধ মেয়েটি ২২ এপ্রিল বিচারিক আদালতে উল্টো সাক্ষ্য দিল। তাকে অপরহরণ করা হয়নি, সে স্বেচ্ছায় তার প্রেমিক জিহানের সঙ্গে গেছে। তাদের মধ্যে প্রেমেরে সম্পর্ক রয়েছে। আদালত তাকে তার বাবা মা’র হেফাজতে দিতে চাইলেও সে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে আদালত তাকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ফরিদপুরের সেইফহোমে পাঠায়। সেই সেইফহোম থেকে জেদী এই মেয়েটি ২০১৬ সালে গোল্ডেন সহ জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি পাস করে।

এ প্রসঙ্গে ২০১৬ সালের ৬ জুন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দীতে তাদের প্রেমের সম্পর্ক জানার পর তার সঙ্গে বাবা মা ফুপু ফুপা’র অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে জানায়। তার ফুপু তার মুখে থুথু নিক্ষেপ, বাবার বেল্ট দিয়ে প্রহার, ঘুমের মধ্যে ইনজেশন দেয়ার ঘটনা তুলে ধরে। অভিভাবকদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে সে জিহানের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। দর্শনায় তার দেড় মাস ঘর সংসারও করে। জিহানের বাবা মা ও পরিবারের প্রতি তার বাবা যে অভিযোগ এনছেন তা’ পুরো মিথ্যা।
এ প্রসঙ্গে শিশু আদালতের পিপি (সরকারি কৌসুলী) অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া বুল জানান, ২০১৫ সালের ১৪ মার্চ সরকারি ভিক্টোরিয়া কেন্দ্র থেকে সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার সময় ওই এসএসসি পরীক্ষার্থীকে অপহরনের অভিযোগ করেন ভিকটিমের বাবা। এ ঘটনায় নবীনগর এলাকার কলেজ ছাত্র সোবাহান উদ্দিন জিহান এবং তার বাবা-মা ও দুই বন্ধু সহ ৫ জনকে আসামী করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭ ধারায় জোরপূর্বক অপহরনের অভিযোগে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। পরে ওই বছরের ২২ এপ্রিল বিচারিক আদালতে ভিকটিম সহ আসামীরা আত্মসমর্পন ঘটনাটি অপহরণ নয় প্রেমঘটিত বলে উল্লেখ করে জামিন প্রার্থনা করেন। এমনকি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৭(২) ধারায় ভিকটিম বিচারিক হাকিমের আদালতে জবানবন্দিতে জানায়, তাকে অপহরণ করা হয়নি, সে স্বেচ্ছায় সোবাহান উদ্দিন জিহানের সাথে চলে গেছে। তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। ভিকটিম তার পিতামাতার হেফাজতে যেতেও অস্বীকৃতি জানায়। পরে আদালত তাকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ফরিদপুরের সেইফ হোমে পাঠায়। এরপর থেকে ভিকটিম ওই সেইফ হোমেই রয়েছে এবং ২০১৬ সালে জিপিএ-৫ সহ এসএসসি পাশ করে। 

এদিকে, সদর থানা পুলিশ ২০১৫ সালের ১ আগস্ট ওই মামলায় জিহানকে অপহরনকারী ও তার বাবা-মা সহ চারজনকে সহায়তাকারী অভিযুক্ত করে ৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে। তবে ভিকটিমের জবানবন্দির প্রেক্ষিতে আদালত জিহান ও তার বাবা-মা সহ আসামীদের জামিন মঞ্জুর করেন। জিহান এসময়ে এইচএসসি পাশ করে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালাতে থাকে। সে এবং তার বন্ধুরা মিলে ‘আর্তনাদ’ নামে স্থানীয়ভাবে একটি স্বেচ্ছাসেবি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলে নানা সামাজিক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করতে থাকে। জিহান আর্তনাদের বর্তমান কমিটির সভাপতি।
মামলাটির বিচার কার্যক্রম চলার পর্যায়ে ১৪ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে বৃহস্পতিবার শিশু আদালতের বিচারক সোবাহান উদ্দিন জিহানকে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমান আইনের ৭ ধারায় অপরনের দায়ে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ডাদেশ ঘোষনা করেন। অপর চার আসামীকে খালাস প্রদান করেন। 
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি অ্যাডভোকেট গোলাম কিবরিয়া বুলু রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, রায়ে মূল অপহরনকারির সাজা হয়েছে। এখানে ভিকটিম মাইনর (কম বয়স) হওয়ায় তার জবানবন্দি আদালত আমলে নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।

তিনি জানান, ভিকটিম পূর্ন বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত সরকারি সেইফ হোমে থাকবে এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর নিজ জিম্মায় যেতে পারবে। আসামীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম আধার জানান, ঘটনাটি অপহরণ প্রমাণিত হয়নি। তবে ভিকটিমের বয়ম কম হওয়ায় আদালত তার জবানবন্দি আমলে না নিয়ে সাজার রায় দিয়েছেন। মুলত; এটি একটি প্রেমের ঘটনা। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপীল করা হবে।
এ বিষয়ে জিহানের বাবার বক্তব্য মেয়েটি এখনো অপ্রাপ্তবয়স্কা। ইতিপূর্বেও মেয়েটি তার বাড়িতে চলে এলে তিনি নিজে মেয়ের অভিভাবকদের ডেকে এনে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও মেয়ের বাবা ডাক্তার সাহেব তাদের পরিবারের বিরূদ্ধে মিথ্যা মামলা দয়ের করেন। বিচারক ছেলেকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তিনি মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই ও ছেলের মুক্তি দাবী করেন। 
অপরদিকে মেয়ের মা বলেছেন, জিহানের পরিবার মেয়েটির এমনভাবে ব্রেইনওয়াশ করেছেন যে, মেয়েটি তার পরিবারের স্ট্যাটাস ভুলে জেদ আর মিথ্যা আবেগে আবদ্ধ হয়ে গেছে। একদিন সে তার ভুল বুঝতে পারবে। তার মেয়ে মেধাবী, নাচে, গানে, বিতর্কে তুখোড়। জিহানের শাস্তি প্রসঙ্গে তিনি জানান, আল্লার দোয়ায় সঠিক বিচার হয়েছে। 
Collect ইত্তেফাক/

No comments

Powered by Blogger.